আমরা কি সত্যিই বেঁচে আছি, নাকি শুধুমাত্র শ্বাস নিচ্ছি? আমাদের শরীর জীবিত থাকলেও যদি অন্তর মৃত হয়, তবে আমাদের প্রকৃত জীবনের কোনো মূল্য নেই। ইসলাম আমাদের শেখায় যে আত্মা (রুহ) জীবন্ত থাকে তখনই, যখন আমরা অন্যের কষ্ট অনুভব করতে পারি, তাদের সাহায্য করার জন্য উদ্যোগী হই, এবং আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করি।
কিন্তু কিভাবে বুঝব আমাদের আত্মা জীবন্ত? রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন যে, একজন মুমিনের অন্তর তখনই জীবন্ত থাকে, যখন সে অন্যের কষ্টে ব্যথিত হয়। আসুন, আধুনিক সমাজের প্রেক্ষাপটে এই বিষয়টি আমরা গভীরভাবে অনুসন্ধান করি।
আধুনিক সমাজ: অনুভূতির অভাব এবং অন্তরের মৃত্যু
আজকের সমাজ আমাদের ভীষণ ব্যস্ত করে ফেলেছে। প্রযুক্তি, প্রতিযোগিতা, এবং ব্যক্তিগত লক্ষ্য আমাদের অন্তরকে শক্ত করে দিয়েছে। আমরা রাস্তার পাশে অসহায় মানুষদের দেখি, কিন্তু আমাদের হাত এগিয়ে যায় না। আমরা খবরের কাগজে বা টিভিতে যুদ্ধ, দারিদ্র্য, এবং দুর্ভিক্ষের ছবি দেখি, কিন্তু আমাদের হৃদয় সাড়া দেয় না।
আমাদের অন্তর কেন এত শক্ত হয়ে গেছে? কারণ আমরা আমাদের জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ভুলে গেছি। আমরা নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, কিন্তু অন্যের কষ্ট আমাদের স্পর্শ করে না। এই অবস্থায় কি আমরা বলতে পারি আমাদের রুহ জীবন্ত?
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের শিক্ষা
১. বৃদ্ধ মহিলার বোঝা বহন
একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) দেখলেন, এক বৃদ্ধ মহিলা ভারী বোঝা নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি মহিলার কষ্ট সহ্য করতে পারলেন না। নবীজি নিজে সেই বোঝা বহন করলেন। মহিলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "তুমি কে?" নবীজি বললেন, "আমি আল্লাহর বান্দা।"
এই ঘটনা আমাদের শেখায়, একজন মুমিনের আত্মা জীবন্ত থাকে তখনই, যখন সে অন্যের কষ্টে সাড়া দেয়।
২. শিশুর প্রতি ভালোবাসা
একবার নবীজি (সা.) নামাজ পড়ছিলেন। এক শিশু তাঁর পিঠে উঠে গেল। নবীজি শিশুটিকে কষ্ট না দিয়ে ধীরে ধীরে নামিয়ে দিলেন এবং বললেন, "শিশুরা আল্লাহর রহমত। তাদের সাথে সদয় হও।"
আজকের সমাজে আমরা কতটা ধৈর্যশীল এবং করুণাময়? আমরা কি ছোট ছোট শিশুদের ভালোবাসা দিতে পারি, নাকি তাদের প্রতি কঠোর আচরণ করি?
৩. তায়েফের ঘটনা
তায়েফে নবীজি (সা.) দাওয়াত দিতে গেলে মানুষ তাঁকে পাথর মেরে তাড়িয়ে দেয়। রক্তাক্ত অবস্থায় ফেরেশতা এসে বললেন, "আপনি চাইলে আমি তাদের ধ্বংস করে দিতে পারি।" কিন্তু নবীজি বললেন, "না, আমি আশা করি তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।"
এই ঘটনা আমাদের শেখায়, করুণা ও ক্ষমার মধ্যেই একটি জীবন্ত আত্মার প্রকৃত সৌন্দর্য।
নামাজ পড়া: শুধুমাত্র রীতি নাকি আত্মার পরিশুদ্ধি?
আমাদের অনেকেই নামাজ পড়ি, কিন্তু নামাজের প্রকৃত উদ্দেশ্য কি আমরা উপলব্ধি করি? নামাজ আমাদের শুধুমাত্র শারীরিক একটি কাজ নয়; এটি আমাদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার একটি মাধ্যম। কিন্তু যদি নামাজ পড়ার পরও আমাদের অন্তর কঠিন থাকে, অন্যের কষ্টে সাড়া না দেয়, তবে আমাদের আত্মা কি সত্যিই জীবিত?
নবীজি (সা.) বলেছেন, "তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সর্বশ্রেষ্ঠ, যার হাত ও জিহ্বা থেকে অন্যরা নিরাপদ থাকে।" নামাজ আমাদের শিখায়, কিভাবে আমরা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করব এবং মানবতার প্রতি সদয় হব।
আপনার আত্মা কি জীবন্ত? একটি প্রশ্ন নিজেকে জিজ্ঞেস করুন
- আপনি কি অন্যের কষ্ট দেখে কাঁদেন?
- আপনি কি অসহায় মানুষের জন্য কিছু করতে চান?
- আপনার অন্তর কি আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসায় ভিজে যায়?
যদি উত্তর না হয়, তবে আপনার আত্মার প্রতি মনোযোগ দিন। নিজের ভেতরের মৃত্যু অনুভব করুন এবং তা থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করুন।
একটি জীবন্ত আত্মা মানে শুধুমাত্র শ্বাস নেওয়া নয়, বরং অন্যের কষ্ট অনুভব করা, তাদের সাহায্য করা এবং আল্লাহর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করা। রাসুলুল্লাহ (সা.) এবং সাহাবীদের জীবন আমাদের দেখায়, কিভাবে একটি আত্মা জীবন্ত রাখা যায়।
আসুন, আমরা আমাদের অন্তরকে পরীক্ষা করি। আমরা কি জীবিত, নাকি মৃত? আমাদের নামাজ, দান, এবং ভালো কাজের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে নিজেদের আত্মাকে জীবন্ত রাখার চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করুন।
আপনার অন্তর কি জীবন্ত? আপনি কি অন্যের কষ্ট অনুভব করতে পারেন? নিজের উত্তর নিজেকে দিন।

0 Comments