সমাজের উন্নয়ন শুধুমাত্র অবকাঠামো, অর্থনীতি, বা প্রযুক্তির অগ্রগতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এর মূলে রয়েছে মানুষের নৈতিকতা, বিবেক, এবং বিশেষভাবে নারীর আত্মশক্তি। নারীরা যদি নিজেদের বিবেক বিসর্জন দেন, ক্ষমতা বা টাকার লোভে আত্মসমর্পণ করেন, তাহলে উন্নয়ন শুধু অসম্ভবই নয়, বরং সমাজের অবক্ষয় আরও ত্বরান্বিত হয়।
আমরা প্রতিদিনই সমাজে নানা অপরাধ দেখি—ধর্ষণ, নির্যাতন, খুন, দুর্নীতি। কিন্তু যারা এই অপরাধ করে, তারা তো কারো ভাই, কারো সন্তান, কারো জামাই। তাহলে কেন তাদের পরিবার, বিশেষ করে মায়েরা, স্ত্রী কিংবা বোনেরা তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান না? কেন তারা চুপ থাকেন? উত্তরটা কঠিন কিন্তু স্পষ্ট—তারা হয়তো সামাজিক সম্মান, ক্ষমতা, বা আর্থিক সুবিধার জন্য আপস করেন।
কিন্তু এই আপসের পরিণতি কী? অপরাধীর সংখ্যা বাড়তে থাকে, তারা আরও দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠে, এবং একসময় পুরো সমাজটাই একটি বিকৃত ব্যবস্থার অংশ হয়ে যায়।
ইসলামের আলোকে নারীর শক্তি ও প্রতিবাদ
ইসলামের ইতিহাসে এমন বহু উদাহরণ রয়েছে যেখানে নারীরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন, পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়েও সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
আসিয়া (ফিরাউনের স্ত্রী): তিনি ছিলেন দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাধর এক স্বৈরাচারী শাসকের স্ত্রী। কিন্তু যখন তিনি দেখলেন তার স্বামী অন্যায় করছে, নবী মুসাকে হত্যা করতে চায়, তখন তিনি সত্যের পক্ষে দাঁড়ালেন। তার এই অবস্থানের জন্য তিনি চরম নির্যাতনের শিকার হন, কিন্তু তিনি নত হলেন না।
খাদিজা (রাঃ): তিনি রাসূল (সা.)-এর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন এমন এক সময়ে যখন পুরো মক্কা তাঁর বিরুদ্ধে ছিল। তাঁর বিশ্বাস, সাহস, ও আত্মশক্তিই নবুয়তের শুরুতে ইসলামের অন্যতম ভিত্তি তৈরি করেছিল।
সুমাইয়া (রা.)
ইসলামের প্রথম শহিদ সুমাইয়া (রা.) ছিলেন অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক। তিনি মক্কার কুরাইশ নেতাদের অত্যাচার ও নির্যাতনের মুখেও ইসলামের পথে অটল ছিলেন। তিনি পরিবার ও সমাজের চাপ উপেক্ষা করে সত্যের পথে অবিচল ছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত শাহাদাত বরণ করেন।
নুসাইবা বিনতে কাব (রা.)
নুসাইবা (রা.) ছিলেন একজন সাহসী যোদ্ধা এবং ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ নারী। তিনি উহুদ যুদ্ধে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর পাশে থেকে যুদ্ধ করেছিলেন এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সাথে লড়াই করেছিলেন।
রাবিয়া বসরি (রা.)
রাবিয়া বসরি (রা.) ছিলেন একজন আধ্যাত্মিক নেত্রী এবং সমাজ সংস্কারক। তিনি ধন-সম্পদ ও ক্ষমতার মোহকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং আল্লাহর প্রেম ও ন্যায়ের পথে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। মানুষের হৃদয়ে আধ্যাত্মিকতার আলো জ্বালিয়েছিলেন।
বিলকিস (রানী সাবা)
কুরআনে উল্লিখিত রানী সাবা বা বিলকিস ছিলেন একজন বিচক্ষণ ও ন্যায়পরায়ণ শাসক। তিনি তার রাজ্যে ন্যায় ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন। তিনি নবী সুলাইমান (আ.)-এর সাথে সাক্ষাতের মাধ্যমে সত্যের পথে পরিচালিত হন এবং তার রাজ্যে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেন।
এই নারীরা শুধু ইসলামের ইতিহাসের অংশই নন, তারা ন্যায় ও সত্যের পথে সংগ্রামের প্রতীক। তারা পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তাদের জীবনী আমাদেরকে শিক্ষা দেয় যে, নারীরা শুধু পরিবারের আলোই নয়, তারা সমাজের পরিবর্তনেরও প্রধান চালিকাশক্তি।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: অপরাধীদের পরিবার কেন চুপ?
আমরা যখন দেখি কোনো মেয়েকে রাস্তায় হয়রানি করা হচ্ছে, ধর্ষণ করা হচ্ছে, খুন করা হচ্ছে—তখন অপরাধীদের মায়েরা, বোনেরা, স্ত্রী বা পরিবারের সদস্যরা কোথায় থাকেন? তারা কি জানেন না যে তাদের ঘরের ছেলেটি এমন করছে? জানেন, কিন্তু চুপ থাকেন। কারণ সমাজ তাদের শিখিয়েছে , নিজের পরিবারের দোষ ঢেকে রাখো, লোকের সামনে মুখ দেখাতে পারবে না।
কিন্তু এই চুপ থাকাটাই অপরাধকে লালন-পালন করছে। যে মা জানেন তার ছেলে ধর্ষক, কিন্তু তবুও তার জন্য রান্না করে খাওয়ান, যে স্ত্রী জানেন তার স্বামী দুর্নীতিবাজ, কিন্তু তবুও বিলাসী জীবন উপভোগ করেন তারাও অপরাধের অংশ।
যেদিন সমাজের নারীরা সত্যের পক্ষে দাঁড়াবেন, যেদিন তারা পরিবারকে রক্ষা করতে গিয়ে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেবেন না, সেদিনই পরিবর্তন আসবে।
পরিবর্তনের জন্য কী করা দরকার?
১. নারীদের আত্মজাগরণ: নারীদের শিখতে হবে যে তারা কেবল মা, বোন, স্ত্রী নয়—তারা সমাজ পরিবর্তনের এক বিশাল শক্তি। তাদের প্রতিবাদ করা শিখতে হবে।
2. নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব: সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই শিক্ষা দিতে হবে যে ন্যায়-অন্যায় কী। শুধু ধর্মীয় শিক্ষা দিলেই হবে না, বাস্তব জীবনে নৈতিক শিক্ষা কীভাবে প্রয়োগ করতে হয়, তা শেখানো দরকার।
3. পরিবারের দায়িত্ব: মায়েরা, বাবারা যদি দেখেন তাদের সন্তান অন্যায় করছে, তাহলে চুপ না থেকে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। আমার ছেলে কিছুতেই খারাপ হতে পারে না এই মানসিকতা বদলাতে হবে।
4. আইন ও বিচার ব্যবস্থা: যারা অন্যায় করে, তাদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধী যদি রাজনৈতিক বা ক্ষমতাশালী পরিবারের হয়, তাহলে শাস্তির হাত এড়িয়ে যেতে পারবে না।
শেষ কথা: পরিবর্তন আসবে নারীদের হাত ধরেই
আমরা প্রতিদিন নির্যাতনের গল্প শুনি, চোখ বন্ধ করে এড়িয়ে যাই। কিন্তু মনে রাখতে হবে—আজ যদি অন্যের মেয়ের সাথে হয়, কাল তা আমাদের পরিবারের সাথেও ঘটতে পারে।
তাই নারীদের শক্তি বাড়াতে হবে। তারা যদি নিজেদের বিবেক বিসর্জন না দেন, তাহলে সমাজ বদলাবে। কিন্তু যদি তারা শুধুই ক্ষমতার মোহে নিজের আত্মা বিক্রি করে দেন, তাহলে উন্নয়নের কথা ভুলে যাওয়া উচিত।
ইসলামের ইতিহাস বলেছে, সত্যের জন্য নারীরা লড়েছেন। তাহলে আজ কেন আমরা চুপ থাকবো? যেদিন মা, বোন, স্ত্রী সত্যের পক্ষে দাঁড়াবেন—সেদিনই এই সন্ত্রাসীদের পতন অনিবার্য হবে।
_ আবির হোসেন

0 Comments