সাংবাদিকতা এবং ঝুঁকি এই দুটো শব্দই একটি অপরটির পরিপূরক । পৃথিবীর কোন পেশায় হয়তো এত পরিমাণ ঝুঁকিতে প্রতিনিয়ত পড়তে হয় না । অদম্য সাহস নিয়ে চলতে হয় এদের । যুদ্ধের ময়দানে হাজারো প্রতিকূল পরিবেশ টেক্কা দিয়ে তুলে আনতে হয় সেখানকার বাস্তবতা । এমনই কিছু যোদ্ধা সাংবাদিক নিয়ে কথা বলব আজকে ।
মার্গারেট ব্রুক হোয়াইট - যুক্তরাষ্ট্র
যখনই কোন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে সংবাদ সংগ্রহের কথা ভাবা হতো তখনই হয়তো পুরুষ সাংবাদিকের কথা মাথায় আসতো । কিন্তু সবাইকে তাক লাগিয়ে এই চিন্তাকে ধূলিসাৎ করে দেয় মার্গারেট ব্রুক হোয়াইট । ইতিহাসের পাতায় তিনিই প্রথম নারী সাংবাদিক হিসেবে যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করেন । যার কারণে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন ইতিহাসের পাতায় । তিনি কি পরিমাণ সাহসিকতা নিয়ে কাজ করেছেন তা তার কাজের ভিতরেই প্রকাশ পায় । যেমন তিনি একমাত্র বিদেশি ফটোগ্রাফার যে কিনা সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিতরকার কার্যকলাপের ছবি তোলার অনুমতি পেয়েছিল । তাছাড়াও উপমহাদেশের বিভাজনের সময়টুকুতে বিশেষ করে পাক ভারত বিভাজনের সময় তার তোলা অনেক বিখ্যাত ছবি রয়েছে ।
পিটার অরনেট - নিউজিল্যান্ড
নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাংবাদিক ভাবা হয় পিটারকে । তার বিশেষত্ব ছিল যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি অসাধারণ ছবি তুলে আনতে পারতেন । যা পরবর্তীতে বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করত । ১৯৬৬ সালে তিনি পুলিৎজার লাভ করেন ভিয়েতনাম যুদ্ধ কভার করার জন্য । ভিয়েতনাম যুদ্ধের ভয়াবত সম্পর্কে আমরা কম বেশি অবগত । কিন্তু তিনি নিজের মৃত্যুভয়কে পিছনে ফেলে তুলে আনেন অসাধারণ সব ছবি । তিনি তো শুধুমাত্র ভিয়েতনাম যুদ্ধ কভার করেছেন এমন নয় । প্রথম পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় তিনি তার সাহসিকতার পরিচয় দেন ।
কিশোর পারেখ - ভারত
তার নাম কিশোর হলেও কাজের ভিতর ছিল বীরের ছাপ । এই সাহসী সাংবাদিকের জন্ম ১৯৩০ সালে ভারতে। তিনি চলচ্চিত্র , তথ্যচিত্র ও স্থিরচিত্রের উপরে সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি লাভ করেন । তিনি প্রথম ক্যামেরা হাতে তুলে নেন ১৯ বছর বয়সে । প্রায় সাত বছর কাজ করেন হিন্দুস্তান টাইমসে। সময়টা ছিল ১৯৬১ থেকে ১৯৬৭ । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যে কজন ক্যামেরা যোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের চিত্র ক্যামেরায় ধারণ করেছিলেন তাদের ভিতরে অন্যতম বিবেচনা করা হয় কিশোর পারেখকে । তিনি সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে কাজগুলো সম্পন্ন করেছেন । মাত্র আট দিনে তিনি ছবি তুলেছিলেন ৬৭ টি যেটি মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে আছে এখনও । একজন সাধারণ মানুষ হয়ে যুদ্ধের ছবি তোলা যে কতটা দুষ্কর হতে পারে সেটা হয়তো তিনি আগে আচ করতে পেরেছিলেন । সেজন্যই হয়তো পাকিস্তান আর্মির পোশাক জোগাড় করে তিনি এসব কাজ সাহসিকতার সাথে সম্পন্ন করেছিলেন ।
| কিশোর পারেখ |
রশিদ তালুকদার - বাংলাদেশ
এই সাহসী ক্যামেরা যোদ্ধার জন্ম হয় ১৯৩৯ সালের ২৪ শে অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনায়। তার হাতেখড়ি হয় মোতাহার হোসেনের কাছে । তিনি প্রথমে যোগ দেন দৈনিক সংবাদ ১৯৬১ সালে । সেখানে প্রায় কাজ করেন ১৩ বছরের মত । পরবর্তীতে তিনি ৩২ বছর ( ১৯৭৫ - ২০০৭ ) কাজ করেন দৈনিক ইত্তেফাক এ ফটো সাংবাদিক হিসেবে । এই বাংলার মাটিতে যখনই মুক্তিযুদ্ধের কথা তোলা হয় তখনই উঠে আসবে রশিদ তালুকদারের নাম । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বহু সাক্ষী প্রমাণ বন্দী হয়েছে তার ক্যামেরায় । নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছবি তুলেছে শুধুমাত্র দেশের স্বার্থের জন্য ।
| বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের সাথে রশিদ তালুকদার |
সাইমন ড্রিং - ব্রিটিশ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সাইমন ড্রিং এর অবদান অনস্বীকার্য । মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ২৭ বছর । তখন তিনি ছিলেন নামকরা পত্রিকা ডেইলি টেলিগ্রাফ একজন সাংবাদিক । বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা । কিন্তু একসময় দেশের পরিস্থিতি সাংবাদিকদের জন্য প্রতিকূলে চলে যায় । অনেক বিদেশি সাংবাদিক দেশ ত্যাগ করে চলে যায় । কিন্তু সাইমন ড্রিং ছিলেন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম । তিনি দেশত্যাগ না করে জীবনে ঝুঁকি নিয়ে লুকিয়ে থাকেন হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে । বেরিয়ে আসেন ২৭ তারিখ । তখন ঢাকার রাজপথ ছিল রক্তাক্ত । তিনি পাকিস্তানী বাহিনীর নৃশংসতার ছবি ক্যামেরাবন্দি করে পালিয়ে যান ব্যাংককে । সেখান থেকে প্রকাশ করেন ‘ট্যাংকস ক্রাশ রিভল্ট ইন পাকিস্তান’। বিশ্ববাসীর সামনে তিনি তুলে ধরেন নির্মম বাস্তবতাকে। তার পাঠানো খবরেই নড়েচড়ে বসে পুরো বিশ্ব। ২৫ মার্চ কালরাতের পর ঢাকার ভয়াবহ নির্মম পরিস্থিতি প্রকাশ করেন তিনি।
0 Comments