REPORTING FACTS , NOT FICTION

6/recent/ticker-posts

ঢাকার নীরব কারিগর: এক অপমানিত জীবনের আর্তনাদ


ঢাকা শহরটা যেন একটা বিশাল যন্ত্র, আর সেই যন্ত্রের সব চাকা সচল রাখে একদল নীরব কারিগর—কাজের বুয়ারা। এই শহরের আলো ঝলমলে বাড়িগুলোর মধ্যে ওরা যেন হারিয়ে যাওয়া ছায়া। তাদের জীবনের গল্পগুলো আমাদের চোখের সামনে থাকলেও আমরা খুব কমই সেদিকে তাকাই।


ওদের জীবনটা এক বৃত্তের মতো—ভোর হতে না হতেই ঘর থেকে বের হওয়া, দিনের পর দিন মালিকদের ঘরের কাজ করে ফেরা। কিন্তু এই বৃত্তের ভেতরে ঢুকলে দেখা যাবে তীব্র কষ্ট, ক্ষুধা আর বঞ্চনার দাগ।


শহরের মঞ্চে লড়াই

ঢাকার জীবন শুধু কোলাহল আর ব্যস্ততার নয়, এটা এক অবিচার আর বৈষম্যের প্রতিচ্ছবি। কাজের বুয়ারা এই বৈষম্যের এক কঠিন উদাহরণ। ওরা ঘরে ঘরে আলো জ্বালায়, কিন্তু নিজের ঘরে অন্ধকার রেখে। কখনো সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর টাকা জোগাড় করতে দিনের খাবারও বাদ দেন।

ওদের অনেকেই শিশু। দশ বা বারো বছরের বাচ্চারা, যারা নিজের খেলাধুলোর সময় পার করে বাচ্চা সামলায়, বাসন মাজে। এই শহরে যে শিশুরা স্কুলে যাওয়ার কথা, তারা কেন কাজ করছে? কারণ পরিবারগুলোর আর কোনো উপায় নেই।

মনের গভীর ক্ষত

কাজের মেয়েরা যে নির্যাতনের শিকার হন, তা সমাজের একটি অন্ধকার দিক, যা অনেক সময় চোখে পড়ে না বা মনের গভীরে চাপা পড়ে থাকে। তাদের প্রতি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন কেবল তাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই নির্যাতন কখনো কখনো সোজাসুজি আঘাতের রূপ নেয়, আবার কখনো ভাষার মধ্য দিয়ে, যা তাদের আত্মসম্মানকে আঘাত করে। এ ধরনের নির্যাতন তারা মুখ ফুটে বলতে পারে না, কারণ তারা জানে যে, তাদের পাশে কেউ নেই, বা তাদের পক্ষে কথা বলার সাহস নেই।


একটি কাজের মেয়ে দিনের পর দিন একাধিক বাড়ি পরিস্কার করে, কিন্তু সেই পরিশ্রমের মূল্য শুধুমাত্র টাকা নয়, বরং সম্মান এবং মনোযোগেরও হওয়া উচিত। কিন্তু অধিকাংশ সময় তারা শুধু কাজের যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাদের ওপর শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন ঘটে, তাদের কোনো মতামত বা অনুভূতি গুরুত্ব পায় না। এবং সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, এই নির্যাতনগুলোর অধিকাংশই চুপচাপ, অজানা এবং অঘোষিত থাকে।

শিশুদের স্বপ্নের ভার

এই নারীরা শুধু নিজেদের জন্য নয়, সন্তানদের জন্য স্বপ্ন দেখেন। তাঁরা চান তাঁদের সন্তান যেন পড়াশোনা করে, ভালোভাবে বাঁচে। একটা নতুন বই কিনে দেওয়ার জন্য তাঁরা নিজের নতুন জামাকাপড়ের চিন্তাও বাদ দেন। কিন্তু শিশুরা কি আদৌ সেই সুযোগ পায়?


তাঁদের অনেকের সন্তান স্কুল থেকে ঝরে পড়ে, কারণ পরিবারের পক্ষে স্কুলের খরচ চালানো সম্ভব হয় না। একদিন এক মাকে বলতে শুনেছিলাম, "মেয়ে পড়াশোনা শিখলে আমার মতো এভাবে বাড়ি বাড়ি কাজ করতে হবে না।"


স্বাস্থ্য আর নিরাপত্তা

তাঁদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে আমরা কেউ কি ভাবি? প্রতিদিন ভারী কাজ করতে করতে তাঁদের শরীর ভেঙে পড়ে। চিকিৎসার সামর্থ্য নেই, ফলে অনেকেই অসুস্থ অবস্থায় কাজ চালিয়ে যান। উপরন্তু, কর্মস্থলের নিরাপত্তাহীনতা আরও এক বড় সমস্যা।


সম্মান ও দায়িত্ব

তাঁরা শুধু আমাদের কাজের লোক নন; তাঁরা এই শহরের নীরব স্তম্ভ। আমরা যদি তাঁদের সম্মান না করি, তাঁদের জন্য ন্যূনতম সুযোগ না তৈরি করি, তবে কিভাবে এই শহরের মানবিকতা টিকে থাকবে?

কিছু ছোট পদক্ষেপ তাঁদের জীবনে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। মাসিক বেতনটা সময়মতো দেওয়া, খাবারের দিকে একটু খেয়াল রাখা, আর সবচেয়ে বড় কথা, তাঁদের মানুষ হিসেবে সম্মান করা।


এই শহরের প্রতিটা গলিতে তাঁদের গল্প লুকিয়ে আছে। তাঁরা হারিয়ে যাওয়া কিছু মুখ, যাদের মুখে এক চিলতে হাসি আনতে পারলেই আমরা নিজেদের মানুষ বলে ভাবতে পারব। কাজের বুয়ারা ঢাকার অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া নয়; তাঁরা আলো ছড়ানোর কারিগর। তাঁদের চোখের জল আমাদের বিবেককে প্রশ্ন ক

রে—কখন আমরা ওদের মানুষ হিসেবে দেখব?




Post a Comment

0 Comments