এই দুনিয়া: আসলেই কী আমাদের কিছু আছে?
কখনো কি ভেবে দেখেছেন, আমরা প্রতিদিন যে দৌড়ের ওপর আছি, তার শেষ কোথায়? আমরা এত কিসের জন্য ছুটছি? চাকরি, টাকা, সম্পর্ক, সম্মান—এসব অর্জন করেও কেন আমাদের মনে শান্তি আসে না? আমরা কি আসলেই সেই জিনিসগুলো ধরার চেষ্টা করছি, যা আমাদের কখনোই ছিল না?
এই পৃথিবী এক বিশাল পরীক্ষা। আমাদের আশেপাশের যা কিছু—সম্পদ, সম্পর্ক, খ্যাতি—এসব আসলে আমাদের নিজেদের নয়। দুনিয়া আমাদের শুধু একটি সাময়িক জায়গা, যেখানে আমাদের আচার-আচরণ, ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা, আর আল্লাহর প্রতি আমাদের বিশ্বাস যাচাই করা হয়।
কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন:
"এই দুনিয়ার জীবন শুধু ধোঁকাবাজির খেলা এবং সামান্য উপভোগ মাত্র।"
— (সূরা আল-হাদিদ, আয়াত ২০)
তাহলে প্রশ্ন হলো, আমরা কেন এমন কিছু নিয়ে এত লড়াই করি, যা ক্ষণস্থায়ী? কেন এমন কিছু চাই, যা একদিন চলে যাবে?
জীবন: এক অনন্ত দৌড়ের মঞ্চ
আজকের আধুনিক সমাজে আমরা সবাই একটি 'র্যাট রেস'-এর অংশ। স্কুল, চাকরি, সম্পর্ক—সব জায়গায় প্রতিযোগিতা। যে জীবনের পিছনে আমরা এত মরিয়া হয়ে ছুটছি, সেটার প্রকৃত উদ্দেশ্য কী? এই প্রশ্ন আমাদের সবার মনেই জাগা উচিত।
দুনিয়ার চক্রটি এমন যে, আমরা একটি সমস্যার সমাধান করলেই আরেকটি সমস্যা আমাদের সামনে দাঁড়ায়। আমরা মনে করি, টাকা থাকলে সুখ আসবে। কিন্তু টাকা আসার পরেও কি আমাদের শান্তি মেলে? সম্পর্ক গড়ার পরেও কি আমাদের মনে শূন্যতা থাকে না? কারণ, আমরা ভুলে যাই যে, দুনিয়ার এই সবকিছুই আমাদের পরীক্ষা করার জন্য।
কোরআনের ভাষায়:
"তোমরা জানো কি, দুনিয়ার এই জীবন কেবলই খেলা ও আমোদ-প্রমোদের জন্য, আর পরকালই আসল জীবন, যদি তোমরা জানতে।"
— (সূরা আনকাবুত, আয়াত ৬৪)
আমাদের নেয়ামত ও কষ্ট: দুটোই পরীক্ষা
আমরা যখন জীবনে কিছু অর্জন করি, তখন মনে করি, এটি আমাদের পরিশ্রমের ফল। আর যখন কিছু হারাই, তখন মনে হয়, জীবন আমাদের প্রতি অবিচার করেছে। কিন্তু আসল সত্য হলো, যা কিছু আমাদের হাতে আসে, তা পরীক্ষার জন্য দেওয়া হয়েছে। আর যা কিছু চলে যায়, তা কখনোই আমাদের ছিল না।
দুনিয়ার নেয়ামত আমাদের পরীক্ষা করে কৃতজ্ঞতায়। আমরা কি আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাই, নাকি অহংকার করি? আবার কষ্ট আমাদের পরীক্ষা করে ধৈর্যে। আমরা কি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখি, নাকি হতাশায় ডুবে যাই?
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
"মুমিন ব্যক্তির অবস্থা সত্যিই বিস্ময়কর। তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই কল্যাণকর। যদি সে কোনো নেয়ামত পায়, সে কৃতজ্ঞতা জানায়। আর যদি কষ্ট পায়, সে ধৈর্য ধরে।"
— (সহীহ মুসলিম)
এই হাদিস আমাদের দেখায় যে, দুনিয়ার প্রতিটি মুহূর্তই আমাদের জন্য একটি সুযোগ—আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের।
ক্ষতি ও হারানো: যা ছিল না, তা হারায় কীভাবে?
আমরা প্রায়ই কষ্ট পাই, কারণ আমরা এমন কিছু হারাই, যা আমাদের মনে হয় আমাদেরই ছিল। কিন্তু সত্য হলো, কিছুই আমাদের নিজের ছিল না। দুনিয়ার প্রতিটি নেয়ামত, প্রতিটি সম্পর্ক, এমনকি আমাদের নিজের জীবনও আল্লাহর আমানত।
কোরআনে আল্লাহ বলেছেন:
"যে নিয়ামত তোমাদের কাছে আছে, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর যদি তিনি তা ফিরিয়ে নেন, তাহলে তা ফেরানোর কেউ নেই।"
— (সূরা আন-নাহল, আয়াত ৫৩)
আমাদের এই উপলব্ধি করতে হবে যে, এই দুনিয়া শুধুই একটি মাধ্যম। এটি একটি মঞ্চ, যেখানে আমরা আমাদের আখিরাতের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।
কেন এই উপলব্ধি প্রয়োজন?
আমরা যদি এই সত্যটা বুঝতে পারি যে, দুনিয়া কেবলই একটি সাময়িক জায়গা, তবে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যাবে। আমরা আর হতাশ হবো না। আমরা আর ক্ষতি বা ব্যর্থতায় ভেঙে পড়বো না। বরং আমরা প্রতিটি অবস্থাকে আল্লাহর পরীক্ষা হিসেবে দেখবো।
যখন আমরা দেখবো, কিছুই চিরস্থায়ী নয়, তখন জীবনের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে। আমরা বুঝতে পারবো, জীবনের আসল অর্থ হলো ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা, এবং আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা।
পরিশেষে
এই দুনিয়া আমাদের জন্য নয়; এটি শুধু একটি পরীক্ষা। আমাদের জীবনের প্রতিটি নেয়ামত ও কষ্ট, প্রতিটি অর্জন ও হারানো—সবই আমাদের পরখ করার জন্য। আমরা যদি বুঝতে পারি যে, এই দুনিয়া চিরস্থায়ী নয়, তবে আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই অর্থবহ হয়ে উঠবে।
"যে কিছু চিরস্থায়ী নয়, তার জন্য দুঃখ করবেন না। বরং সেই চিরস্থায়ী জীবনের জন্য প্রস্তুতি নিন, যা আপনাকে কখনো ছেড়ে যাবে না।"

0 Comments